প্রতিবেদক :হৃদয় চক্রবর্তী।
ভাবতেই অবাক লাগে, নারীরা যখন রাষ্ট্র পরিচালনার মত দূরদর্শী কার্য পরিচালনা করছে ঠিক ওই সময়টাতে দাড়িয়ে আমাদের দেখতে হচ্ছে প্রথম পিরিয়ডেই হারিয়ে গেল একটি জীবন। কে নেবে এই দায়?
কুমারী একটি মেয়ে, বয়স মাত্র তেরো কিংবা চৌদ্দ। জীবনের প্রথম পিরিয়ড শুরু হয়েছিল কিছুদিন আগে। শুরু থেকেই তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। জ্বর, পেটে ব্যথা, অবিরাম রক্তপাত—সব মিলিয়ে প্রায় দশ দিন ধরে ভুগছিল মেয়েটি। “মেয়েদের এমন তো হয়ই!”এই ভেবে গুরুত্ব দেয়নি পরিবারের লোকজন
দুশ্চিন্তা শুরু হয়, অবস্থার অবনতি ঘটতেই। এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়, যখন আর কিছুই করার থাকে না। বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে বিকেলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক জানালেন—মেয়েটি মারাত্মক রক্তশূন্যতায় ভুগছে। জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দরকার, তার ব্লাড গ্রুপ AB+।
রাত ১টার দিকে রক্ত জোগাড় হলেও সেই রক্ত নিতে পারেনি শরীর। কারণ, ততক্ষণে না ফেরারদেশে পাড়ি জমিয়েচছে সেই ছোট্ট মেয়েটি। —রক্তশূন্যতার কারণে।
ঘটনাটি সুন্দরবনের একেবারে কোলঘেঁষা, প্রত্যন্ত একটি গ্রামের। মেয়েটির বাড়ি থেকে জঙ্গল মাত্র ২০ গজ দূরে, মাঝখানে শুধু একটি নদী। পল্লিবিদ্যুৎ এসেছে মাত্র চার বছর আগে। এখনো নেই পাকা রাস্তা, নেই কোনো আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।
এই অঞ্চলে ‘মাসিক’ শব্দটি এখনো উচ্চারণযোগ্য নয়। এটি যেন এক অপবিত্র, লজ্জাজনক, নিষিদ্ধ কোনো ঘটনা। এখানকার মেয়েরা এখনো পিরিয়ডকালীন সময়ে স্যানিটারি প্যাডের পরিবর্তে ব্যবহার করে নোংরা, বারবার ব্যবহৃত ন্যাকড়া। স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এতটাই, যে একজন কিশোরী পিরিয়ডের সময় অবিরাম রক্তপাতেও সাহায্য চাইতে পারেনি।
হয়তো অনেকে বলবেন, পরিবারের দোষ। তারা কেন বুঝল না? কেন গুরুত্ব দিল না? তাদেরও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, উত্তর আসবে—তারা জানেই না এসব ব্যাপার। এই অঞ্চলে শিক্ষার হার বলতে গেলে ২ শতাংশেরও কম। এখানকার মহিলারা আধুনিকতা বা শহরের সুযোগ-সুবিধা দেখেছে কেবল টেলিভিশন বা মোবাইল ফোনের পর্দায়।
মানুষের যেখানে চাঁদের বুকে ঘর বানানোর স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে, নারীরা যাচ্ছে মহাকাশে, প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে আঙুলের ডগায়। অথচ এমন এক সময়ে, এমন উন্নত বিশ্বের পাশে—একটি কিশোরী মারা যায় শুধুমাত্র পিরিয়ডের সময় যথাযথ যত্ন না পাওয়ার কারণে।
পিরিয়ড কোনো অভিশাপ নয়। এটি একটি মেয়ের জীবনের এক গৌরবময় সূচনা—নারীত্বের পথে প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু আমাদের সমাজের বহু জায়গায় এখনো এটি লজ্জা, সংকোচ ও অজ্ঞতার কারণে ধামাচাপা পড়ে থাকে।
মেয়েটির মৃত্যু হয়তো ভাগ্য বলে এড়িয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবে এটি আমাদের সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সচেতনতার মারাত্মক ব্যর্থতা।
যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, যদি মা-বাবারা সন্তানদের প্রাথমিক শারীরিক ও প্রজনন শিক্ষা না দেন, যদি স্কুলগুলোতে যৌন ও স্বাস্থ্য শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেওয়া হয়—তবে এমন মৃত্যু আরও ঘটবে।
এই মৃত্যু কেবলই মেয়েটির নয় , এই মৃত্যু আমাদের সভ্য সমাজের যারা ব্যর্থ, সমাজে সঠিক জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে।
পিরিয়ড বা মসিক শব্দগুলো লজ্জার নয় বরং হয়ে উঠুক সম্মান এবং গৌরবের। —এই মৃত্যু যেন আর ছুয়ে না যায় কোনো কিশোরির জীবন।