খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ থেকে সংগৃহীত নিউজ:
ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ছয়টি ব্যাংক থেকে গত এক বছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ব্যাংক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করা হয়েছে। এর পর পরই এই ব্যাংকগুলোতে গণহারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হয়েছে। এতে নিদারুণ কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন এই কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, সব ধরনের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও কোনো কারণ ছাড়াই, এমনকি ব্যাংকিং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই তাদের ছাঁটাই করা হয়েছে। এদিকে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এখনো ছাঁটাই-আতঙ্ক আছে বলে জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের পর পরই ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৩৮ জন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৮০০, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫৪৭, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ৪০০ এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭ জন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত ছিলেন।
তবে চট্টগ্রামের বাইরেও, এমনকি প্রধান কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে।
এভাবে গণহারে ছাঁটাইয়ের ফলে ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তারা বলছেন, ছাঁটাই প্রক্রিয়াটি ছিল সম্পূর্ণ অন্যায় এবং নিয়মবহির্ভূত। কর্মীদের কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা বা কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেক কর্মী সকালে অফিসে গিয়ে দেখতে পান যে তাদের কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড কাজ করছে না। কাকে, কী কারণে বা কী অভিযোগে ছাঁটাই করা হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি কর্তৃপক্ষ; যা ব্যাংকিং নিয়মাবলির পরিপন্থি। ছাঁটাইয়ের কারণ জানতে চাইলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ শুধু জানিয়েছে, এটি ‘হাই অথরিটির নির্দেশ’। সেই কর্তৃপক্ষ কারা, তা স্পষ্ট করেনি ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একজন চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা বা নোটিশ ছাড়াই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৫০ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন চট্টগ্রামের। এই আকস্মিক ছাঁটাইয়ের ফলে কর্মীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ অমানবিক’ এবং সার্ভিস রুলসের পরিপন্থি। তিনি বলেন, বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই তিনি ২০১৬ সালে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়েছিলেন, কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বর্তমানে বেকার এবং তার জন্য পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্যাংকটিতে অতিরিক্ত কর্মী ছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকে কোনো অতিরিক্ত কর্মী ছিলেন না। যদি থাকতেন, তাহলে ব্যাংক আবার নতুন করে কর্মী নিয়োগ দিত না।
একদিকে ছাঁটাই করার পাশাপাশি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গোপনে নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এই নতুন নিয়োগগুলো বেশির ভাগই চট্টগ্রামের বাইরে থেকে করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেখানে ব্যাংক আর্থিক সংকটের কথা বলছে, সেখানে নতুন কর্মীদের দুই-তিন ধাপ ওপরে পদোন্নতি ও বেতন বাড়িয়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যেমন- যিনি অন্য ব্যাংকে প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন, তাকে এখানে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এসভিপি (SVP) বা এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ইভিপি (EVP) পদে উচ্চতর বেতনে নিয়ে আসা হয়েছে।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিযুক্ত হওয়ার পরই ব্যাংকটি থেকে গণহারে ছাঁটাই করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের শুধু গণহারে ছাঁটাই করা হয়েছে তা-ই নয়, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত কর্মীদের কোনো রিলিজ অর্ডার বা অভিজ্ঞতার সনদপত্র দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে আমরা অন্য কোথাও চাকরির আবেদন করতে পারছি না। আমাকে যদি এখন এখান থেকে একটা রিলিজ অর্ডার দেওয়া না হয়, তাহলে আমি তো অন্য ব্যাংকে বা কোথাও আবেদন করলে আমাকে চোর মনে করবে, অথচ আমি তো চুরি করি নাই।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনার পেছনে বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। একটি ‘অদৃশ্য শক্তি’ এই পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ব্যাংকিং খাতকে অস্থিতিশীল করতে এবং চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের ব্যাংকিং পেশা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এটি একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ হতে পারে।
গত জুলাইয়ে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা ও উপশাখার ৫৪৭ জন কর্মকর্তাকে পৃথক ই-মেইলের মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেও তারা চাকরি ফেরত পাননি।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাবি করেছে, ২০২১ সাল থেকে ব্যাংকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অসংগতি রয়েছে। কোনো ব্যাংক নিজেদের অভ্যন্তরীণ ত্রুটি প্রকাশ করে না। অথচ এই ব্যাংক নিজেদের দোষ জনসমক্ষে প্রকাশ করছে।’
অপর একজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘যদি আপনি আমাকে অবৈধ নিয়োগ বলে টার্মিনেট করেন, তাহলে আপনার পুরো অথরিটিকেই টার্মিনেট করতে হবে। কেননা আমার ওই নিয়োগের সঙ্গে সে সময় আপনিও সম্পৃক্ত ছিলেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও সম্পৃক্ত ছিল।’
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ব্যাংকটির চট্টগ্রাম শাখার জোনাল অফিসের হেড হিসেবে যিনি নিয়োগ পেয়েছেন, তিনি এর আগে ব্র্যাক ব্যাংকে কাজ করেছেন। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে তার কোনো ধরনের অভিজ্ঞতাই নেই। তাহলে তিনি কিভাবে ইসলামী ধারার একটি ব্যাংকে এতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেলেন?
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০২১ সাল থেকে ব্যাংকের নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে বেশ কিছু অনিয়মের চর্চা হয়েছে। নতুন পর্ষদ যাচাই-বাছাই করে অযোগ্যদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করেছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়েছে বলেও দাবি করেছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের বর্তমান প্রশাসনের এই দাবি কতটা গ্রহণযোগ্য, তা ভুক্তভোগীদের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রায় এক হাজার কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে। অনেকের বাড়ি শুধু চট্টগ্রাম হওয়ার কারণেও নাম ছাঁটাইয়ের তালিকায় উঠে আসে। ইউনিয়ন ব্যাংক থেকেও প্রায় ৪০০ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেসব ব্যাংকে নতুন করে ছাঁটাই-আতঙ্ক শুরু হয়েছে। আতঙ্কে ভুগছেন বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা যাচাইয়ের নামে মূল্যায়ন পরীক্ষাসহ নানা কৌশল নিচ্ছে ব্যাংকগুলো
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে আবার নতুন করে কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকা করা হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোও একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক কাজ করছে। যদিও এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলেছে, নতুন করে ছাঁটাইয়ের কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একীভূতকরণের যে কৌশল দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, একীভূত হওয়ার তিন বছরের মধ্যে কারও চাকরি যাবে না।
জানতে চাইলে এসআইবিএল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নাজমুস সাদাত খবরের কাগজকে বলেন, এসআইবিএল ব্যাংকে এখন নতুন করে ছাঁটাইয়ের কোনো পরিকল্পনা নেই।
জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে তিনিও এই ব্যাংকের বাদ পড়াদের তালিকায় ছিলেন। পরে তাকে আবার নিয়োগ দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
একই বিষয়ে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘অনেক ব্যাংকেই কর্মকর্তাদের ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পটপরিবর্তনের পর কর্মী ছাঁটাই করছে কিছু ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ। তবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে কোনো ছাঁটাইয়ের ঘটনা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের যে রূপরেখা দিয়েছে, সেখানেও ছাঁটাইয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে, একীভূতকরণের তিন বছরের মধ্যে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অন্যায়ভাবে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, কর্মকর্তাদের ইচ্ছামতো চাকরিচ্যুত করা যাবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নির্দেশনা রয়েছে, তা এখনো বহাল আছে। তবে কোনো নির্দিষ্ট ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে ব্যাংকগুলো ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে বেছে বেছে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এক প্রজ্ঞাপনে নির্দেশনা দেয়, লক্ষ্য অর্জন না করার অজুহাত তুলে ব্যাংকারদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শুধু নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারা বা অদক্ষতার অজুহাতে ব্যাংক-কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা বা পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।