প্রিয়ার জীবনের গল্প -জুলহাজ আলী জীবন
সূর্য তখন মাঝ আকাশে। গরমে পুড়ছে চারদিক। উঠোনের মাটি এতটাই গরম যে খালি পায়ে দাঁড়ালে মনে হয় পায়ের পাতার চামড়া গলে যাবে। সেই উত্তাপের মধ্যে ছোট্ট মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে—দুই হাত দিয়ে কানের লতি শক্ত করে ধরে, মুখ নিচু, চোখ বেয়ে নীরবে ঝরছে অশ্রু। তার নাম প্রিয়া। বাসা রাজশাহীর তেরখাদিয়া গ্রামে। মধ্যবিত্ত ঘরের এই মেয়ে ছোট থেকেই শিখে গেছে—ভালোবাসা কখনো সবার জন্য সমান হয় না।
একই বাড়িতে দুই ভাই আর এক বোনের সঙ্গে বেড়ে উঠলেও বোনটিই যেন মায়ের রাজকন্যা। নতুন স্কুলড্রেস, চকচকে জুতো, ঝলমলে ব্যাগ—সব তার জন্য। প্রিয়ার ভাগ্যে শুধু জোটে পুরনো জামা, মাপ না মেলা জুতো আর কাঁধের ফাটা ব্যাগ। মনে হয় যেন শাস্তিগুলো শুধুই তার জন্য বরাদ্দ। স্কুলে যাওয়ার আগে বইখাতা গুছিয়ে বসে থাকলেও মায়ের নজর পড়ে বোনের দিকে; প্রশ্রয়ের হাসি ওখানেই থেমে যায়।
বড় ভাইয়েরা বাইরে খেলাধুলায় মেতে থাকে, বোন পুতুল নিয়ে খেলে, আর প্রিয়া রোদে দাঁড়িয়ে কাটায় নির্ধারিত তিরিশ মিনিট—কানের লতি লাল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। ছোট্ট চোখগুলো ধীরে ধীরে শিখে ফেলে বাস্তবতার প্রথম পাঠ—মায়ের কাছে তার চাওয়া-পাওয়ার কোনো দাম নেই। কিছু চাইতে গেলেই মা ঠাণ্ডা গলায় বলেন
তোকে কি আমি কখনো কিছুর জন্য বলেছি? যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখ।
বাবা একটু ভালোবাসতেন বটে, কিন্তু তিনি যখন দিনভর খেটে বাড়ি ফিরতেন, সংসারের হিসেবের চাপ তার কথাগুলো ভারী করে দিত। প্রিয়া যখন পরীক্ষার ফি চাইত, বাবা বিরক্ত হয়ে বলতেন
আয় করিস না তো এত খরচ কোথা থেকে আনব?
এই কথাগুলো শুনে ছোট্ট মেয়েটার বুকের ভেতর জমাট কষ্ট পাথরের মতো শক্ত হয়ে যেত।
তবু সে মেধাবী ছাত্রী। ক্লাসে সবসময় সবার চেয়ে ভালো ফল করত, কিন্তু মায়ের চোখে সে কোনোদিনও আদরের মেয়ে হয়ে উঠতে পারেনি। দিন যায়, বছর যায় তবুও শৈশবের সেই তীব্র গরমে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটা তার মনে পুড়ে পুড়ে দাগ কেটে থাকে।
অদৃশ্য বোঝা
ক্লাস ফাইভের পর হঠাৎ চোখের সমস্যা ধরা পড়ে—হয়তো ছোটবেলা থেকে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ডাক্তার বললেন—চোখকে বিশ্রাম দিতে হবে। কিন্তু বিশ্রামের বিলাসিতা প্রিয়ার জীবনে কোনোদিনও ছিল না। পরিবারের সবার কাছে সে যেন চিরকালীন দায়। নতুন বই বা চশমার টাকার জন্যও তাকে অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে—
তোর জন্য এত খরচ করব কেন?
তবুও পড়াশোনা ছাড়েনি সে। স্কুলের প্রথম বেঞ্চে বসা, শিক্ষকের প্রশংসা—এসবই তার বেঁচে থাকার একমাত্র আনন্দ। কিন্তু একসময় বুঝল—পড়াশোনা চালাতে হলে নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হবে।
বারো বছর বয়সে বন্ধুর মাধ্যমে ঢুকে পড়ল এক কার্পেট সেলাই কারখানায়। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ—সুঁইয়ের খোঁচা, উলের ধুলা আর যন্ত্রের একঘেয়ে শব্দে দিন কেটে যেত। মাস শেষে হাতে আসত মাত্র আট হাজার টাকা। সেই টাকাতেই বই-খাতা, টিফিন আর পরীক্ষার ফি মেটাত।
SSC পরীক্ষার সময় তার একটাই ভয় ছিল—হয়তো মা আবার বলবেন, “তোর জন্য এত খরচ করছি কেন?”
ফল বের হল—GPA ৪.৮৭। জানত, আরও ভালো করতে পারত। কারখানার কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর আর মাথা নিয়ে সৃজনশীল উত্তরগুলো লিখতে পারত না। তবুও সে খুশি ছিল—নিজের উপার্জনে পড়াশোনা চালিয়ে আসাই ছিল তার সবচেয়ে বড় জয়।
স্বপ্নের পথে সংগ্রাম
পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার খবরটা শুনে মনে হয়েছিল হয়তো এবার পরিবার গর্ব করবে। কিন্তু খরচের কথা বলতেই একই উত্তর
আমরা এত টাকা দেব কোথা থেকে? নিজে কিছু কর।
কারখানার কাজ একসময় বন্ধ হয়ে গেলে টিউশনি শুরু করে। মাসে দশ হাজার টাকা আসত না। পাশাপাশি জামা সেলাইয়ের অর্ডার নিত—কখনও ১০০, কখনও ১৫০ টাকা। কয়েক বছর এভাবেই কেটে গেল। পরিবারের কারও কাছ থেকে কোনো সাহায্য না পেলেও প্রিয়ার মনে একটাই বিশ্বাস—একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।
অবশেষে এক চাকরির সুযোগ পেল ঢাকায়। মাসিক বেতন ১২,০০০ টাকা। পরীক্ষার সময় ছাড়া বাকি সময় কাজে ব্যস্ত থাকত। প্রথম বেতন হাতে পেয়ে মনে হল—সে সত্যিই নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। এক বছরের মাথায় আরও ভালো চাকরি পেল, বেতন ২২,000 টাকা। টিউশনের আয়ে মাসিক আয় ৫০,০০০ টাকায় পৌঁছাল।
এক বছরের সঞ্চয়ে দাঁড়াল দুই লক্ষ টাকা। প্রিয়া সিদ্ধান্ত নিল—এবার পরিবারের জন্য কিছু করবে। নতুন করে বাড়ির একটি ইউনিট বানাল দুই রুম, দুটি বাথরুম, বারান্দা, ডাইনিং আর রান্নাঘর। প্রতিটি রুম সাজিয়ে দিল আসবাবপত্রে, মনে আশা—এইবার হয়তো পরিবারের চোখে সম্মান পাবে।
কিন্তু বাড়িতে গেলেই বাস্তবতা একই রকম রয়ে গেল। ঈদের বাজার পর্যন্ত বাবা করতেন না। শেষমেশ প্রিয়াই সব করত—অভিমান গিলে চুপচাপ।
ত্যাগের মূল্যহীনতা
চাকরির চতুর্থ বছরে বোনের বিয়ে ঠিক হল। মা ফোন করে বললেন—
ছেলেকে একটা আংটি, ঘড়ি, মেয়েকে কিছু দিতে হবে। অনুষ্ঠানটাও একটু বড় করব।
প্রিয়ার বুক কেঁপে উঠল। ব্যাংক ব্যালান্স দেখে বুঝল—যা সঞ্চয় করেছে তাতে এত বড় আয়োজন সম্ভব নয়। তবুও বোনের জন্য সব করল অফিস থেকে অগ্রিম বেতন, ঋণ—সব মিলিয়ে দেড় লক্ষ টাকা জোগাড় করল। বিয়ের আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কিছুদিন পরই মা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন।
চিকিৎসার দায়িত্বও এল প্রিয়ার কাঁধে। ঢাকার চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে এল। মায়ের সেবা, ঘরের সব কাজ সবই তার ওপর। কিন্তু ব্যক্তিগত খরচের টাকা পর্যন্ত পেত না। যখন চাইত, শুনতে হত,
তোর এত চাহিদা কেন? সংসারের কাজ করছিস, এজন্য তোকে আলাদা টাকা দিতে হবে কেন?”
চার-পাঁচ বছরের সঞ্চয় ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল। প্রিয়া বুঝতে পারল—পরিবারের কাছে সে এক বোঝা ছাড়া কিছুই নয়।
বিয়ে: নতুন খাঁচা
একদিন খবর এল—একজন পাত্র তাকে দেখতে আসছে। মনে কোনো উত্তেজনা ছিল না, শুধু অদ্ভুত ক্লান্তি। প্রথম দেখাতেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, সাত দিনের মধ্যে নতুন সংসারে পা রাখল প্রিয়া। ভেবেছিল—হয়তো এবার ভালোবাসা পাবে।
কিন্তু বিয়ের পরও বাস্তবতা বদলাল না। একদিন তুচ্ছ কথাকাটাকাটির জেরে মেজ ভাই এমনভাবে আঘাত করল যে মাথা ফেটে গেল—পঞ্চাশেরও বেশি ঘুষি আর কিল। সেই থেকে অসহনীয় মাথার ব্যথা প্রিয়ার নিত্যসঙ্গী। ডাক্তার দেখাতে চাইলে স্বামী বলল—
“তোমার পরিবার তোমাকে মেরেছে, চিকিৎসার দায় তাদের।”
শরীরের কষ্টের চেয়েও বেশি যন্ত্রণা দিত মানসিক আঘাত। প্রিয়া বুঝতে পারল—যারা জন্ম দিয়েছে, তাদের কাছে সে অপ্রয়োজনীয়, আর যাকে ভাগ্য দিয়েছে, সেও ভালোবাসা দিতে জানে না।
অদৃশ্য দেয়াল
আজ প্রিয়ার বয়স পঁচিশ। দুই সন্তানের দায়িত্ব আর সংসারের সব কাজ সামলাতে সামলাতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে—
“জীবনের মানে কি শুধুই দায়িত্ব আর বেঁচে থাকার বাধ্যবাধকতা?”
ভালোবাসার জন্য যে তৃষ্ণা ছিল, তা অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। জীবনের সব কষ্ট মিশে গেছে এক অদৃশ্য দেয়ালে—যেখানে নেই বোঝাপড়া, নেই মমতা।
কিন্তু প্রিয়া হার মানেনি।
শূন্য সময়ে কবিতা লেখে, নিজের মনের কথা ফেসবুকে শেয়ার করে। কলম প্যাকেটিংয়ের ছোট্ট আয়ে টুকরো টুকরো স্বাধীনতা খুঁজে পায়। তবুও মাঝরাতে একাকিত্ব গলা চেপে ধরে—
“কোথাও কি আমার নিজের কোনো জায়গা আছে?”
প্রিয়া জানে—তার গল্পের কোনো সুখের সমাপ্তি নেই। তবুও লড়াই থামায়নি। কারণ সে বুঝে গেছে—থেমে গেলে আর কিছুই বাকি থাকবে না।
প্রতিটি সকাল শুরু হয় নতুন সংগ্রামের প্রস্তুতি নিয়ে।
প্রতিটি রাত শেষ হয় এক অজানা প্রশ্নে—
“কখনও কি কেউ সত্যিই তাকে ভালোবেসেছিল?”
শেষকথা
প্রিয়ার জীবন হয়তো অসংখ্য নিঃশব্দ নারীর জীবনকথারই প্রতিচ্ছবি।
ভালোবাসার তৃষ্ণা মিটেনি কোনোদিন, কিন্তু দায়িত্ববোধ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
হয়তো কোনো একদিন সে খুঁজে পাবে নিজের সেই হারানো জায়গাটা—যেখানে প্রিয়া শুধু প্রিয়া, কোনো দায়বদ্ধতার শৃঙ্খল নয়।
কিন্তু ততদিন পর্যন্ত—
সে বাঁচে আছে, শুধু বাঁচার দায়ে।