গ্রামীণ এলাকার ছেলে তৌহিদ। গ্রামের মাঠব-ঘাট, পথ প্রান্তের যেথায় জনপদ খুঁজে পাওয়া যায় সেখানেই রয়েছে ওর পরিচয়। মরু উদ্যানের মতো দীঘি, কিন্তু আকাশ ছায়া স্বপ্ন তার। লোক শুনে নুনের ছিটা দেয়, “ছোকরাটাকে দেখছ! মেট্রিকুলেশন পাস করতে পারল না। যত সব ঢং আর কী?” বন্ধুরা তাকে নিয়ে মস্করা করে লিফাফাদারুস্ত বলে।
তৌহিদের বাবা ফরিদপুর জেলার জজ আদালতের কেরানি। ওর মা নেই। মাকে ও দেখতেও পায়নি। বাবার মুখে শুনেছে যে, ওর মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। তাকে দেখাশোনা করে ওর খালা। বাবা ছুটি পেলেই তাকে দেখতে আসে। এক বৈশাখ মাসের ছুটিতে বাবা ওকে দেখতে এলে ও বায়না শুরু করে বাবার কাছে যেতে। মা মারা ছেলেটার ঐরকম মুখের সামনে শৈশব থেকেই বাবাকে জবাবদিহি করতে হত। আবেগাচ্ছন্ন হয়ে বাবা ওকে বলল “আসছে নতুন ইংরেজি বছর।” তৌহিদ হেসে এক গাল।
বছর পনেরোর বয়সের ছেলেটা মনটা নিখুঁত রাখে ডিটেকটিভ বই পড়ে। মাঝে মধ্যে এমন কাণ্ড করে যেন রহস্য উদঘাটন করেই ফেলে সে। খালা ওকে খুব আদর করে। ওর জন্য প্রায়ই পায়েস রেঁধে দেয়। ছেলেটা বড্ড পায়েস খেতে ভালোবাসে।
একদিন হলো কী? খালার বাড়িতে কিছু অতিথি এলো। এমনি তোই খালার সকল অতিথিকেই সে চেনে। কিন্তু তারা যেন তার চোখে এই প্রথম। কিছু আন্দাজ না করেই অতিথিশালায় বসে পড়ল। খালা অতিথিদের যত্ন করে আয়েশ ফরমান করেছে। নানা আয়োজন। তখনও বুঝে উঠতে পারছে না সে। এদিকে সেইদিন লাল টুকটুকে একটা জমকালো লাল শাড়ি পরে হাজির হলো পুষ্প। পুষ্প হলো তৌহিদের খালাতো বোন। তৌহিদের মাঝ খালার মেয়ে। তৌহিদ থাকে তার ছোট খালার সাথে। পুষ্পকে খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছিল। বয়সের স্বল্পতার কারণে শাড়িতে তেমন লাগছিল না।
অতিথি গণ ওকে এক নজর দেখে নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিল। খালা আমায় পানিপাড়ার বেলের কাছ থেকে ঘুরে আসতে বলল। তৌহিদ মধ্যাহ্ন ভোজের আগেও সেখান থেকে ঘুরে এসেছিল।
খালার ঐরকম লুকোচুরির ব্যাপারটা তৌহিদের পছন্দ হলো না। দুইদিন পর ঐ অতিথিদের লেখা একটা চিঠি এলো। খালা ও পুষ্প বাজারে গিয়েছিল কিছু জিনিসপত্র কিনতে। ডাক হরকরার কাছ থেকে সে চিঠিটা হাতে পায়। সে স্বহস্তে সেটা গ্রহণ করল।
তৌহিদ ছিল খুব অনুসন্ধিৎসু। সে চিঠিটা খাম থেকে বের করে ঠিকানা ও প্রেরকের নামটা দেখে নিল। পড়তে শুরু করল,
“হযরত বিয়ান, আমার সালাম নেবেন। আশা করছি আপনি ও পাত্রী ভালোই আছেন। আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না। পাত্রী খুবই শ্রেয়। এই ধরনের একটি পাত্রীই আমাদের পছন্দ হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব আপনি তারিখ ঠিক করুন। আগামী রবিবার একটা ভালো দিন আছে। রাখুন। খোদা হাফেজ!”
তৌহিদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে এটা এখন ওর বোনের বিয়ের বন্দোবস্ত চলছে।
তৌহিদ পড়াশোনার পাশাপাশিও সামাজিক অধিকার আদায়ে খুবই সজাগ ছিল। সে এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। পুষ্প তার পিঠাপিঠি বোন। সে খালার মিলন আত্মাটা বুঝে উঠতে পারছিল না। পুষ্পর অনিমেষ দৃষ্টি ওর চোখে বারবার আসছিল। খালা চিঠিটা পেয়ে উত্তর পাঠিয়ে দিয়েছেন। তৌহিদ দমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলল। নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদকে এই ব্যাপারে তার কাছে আসার জন্য ধন্যবাদ দিলেন।
রবিবার।
পুষ্পর বিয়ের দিন। বিশাল লোকের সমাগম নেই। এদিকে তৌহিদের ঘাড়ে এসে পড়েছে অনেক দায়িত্ব। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে সে কাজে ব্যস্ত। পুষ্পর মন ভাল না। সে এই বিয়েতে প্রথম থেকেই রাজি ছিল না। তার প্রবল ইচ্ছা সে বড় হয়ে নির্বাহী কর্মকর্তা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া ওর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এগুলো চাপা পড়ে সহ্য করছিল। কিন্তু আর কত? তার মিস্তির ধৈর্য নেই। সে বদ্ধ পরিকর হয়ে ওঠে। আজ ওর ঘরে কেউ থাকবে না। তাই ও গলায় দড়ি দিয়ে মারা যাবে।
তৌহিদ গৃহস্থের কাজ সামলাতে ব্যস্ত। সে পুষ্পর মনের কথা জানত না। তার ধারণা ছিল পুষ্পর এতে মত রয়েছে।
তার পরিকল্পনা শুধু পুষ্পকে এই মহামারী থেকে বাঁচানো। তাকে অম্লজান উপহার দেবে। তৌহিদ আগে থেকেই নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলে রেখেছিল।
“এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
একদিকে পুষ্প মরণ ফাঁদে মুক্তি খুঁজছে, অন্যদিকে তৌহিদ এই অন্ধকার দূর করার পণ।
সঠিক সময়েই হাজির হলেন নির্বাহী কর্মকর্তা। গাড়ির আওয়াজ শুনেই তৌহিদ সেখানে হাজির। বাড়ির সব আত্মীয় এসে শোরগোল সেখানে।
কর্মকর্তা সাহেব খুবই দক্ষ ছিলেন। তিনি এসেই দৌড়ে ছুটে যান পুষ্পর ঘরে। ততক্ষণে পুষ্প গলায় দড়ি বাঁধতে আরম্ভ করেছে।
মরণ নিশ্চিত বুঝে শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে চোখ বুজে জল ফেলতেই লাফিয়ে এসে নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে জড়িয়ে ধরে আত্মহত্যা থেকে বাঁচালেন।
সবাই পুষ্পর এই কাণ্ডের ব্যাপারে হতবাক হয়ে গেল।
তৌহিদ আরও সজাগ হয়ে বেঁকে বসে। তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার রোল পড়ে যায়—
“তুই কেন করতে গিয়েছিলি এসব, আমাকে বলতে পারতি তো।”
“খালা, তুমি আমায় বিয়ে দিতে চেয়েছ। তাই আমি এর থেকে মুক্তি নিচ্ছিলাম।”
“হতভাগা, দারিদ্র্যের কাছে সুযোগ এসেছিল। তাও যদি তুই এখন এরকম করিস।”
নির্বাহী কর্মকর্তা এবার সবাইকে লক্ষ্য করে বাল্যবিবাহের কুফলগুলো বলেন।
পুষ্পও সকল আত্মীয়ের সামনে হাত জোড় করে বলে,
“আমাকে কি পড়াশোনা করতে দেবে না খালা? আমার কি এই দারিদ্র্য বলে বাল্যবিয়ের সুযোগ দেখিয়ে ধ্বংস করবে?”
“আপনাদের সবাইকে বলছি— মেয়ে বলে তাকে পেছনে রাখবেন না। তাকেও তার যোগ্য মতো সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে দিন। সে-ও একদিন এই কালো মেঘ ঢাকা সমাজকে পরিবর্তন করবে।” – নির্বাহী কর্মকর্তা।
সকলের মগজে নেড়ে উঠল এই ঘটনা থেকে। খালা সহ গ্রামের লোক সবাই মর্যাদাবোধ শিখল।
গ্রামের সব মেয়েরা নিয়মিত বিদ্যালয়ের পাঠদানে অংশ নিচ্ছে। তৌহিদ ছেলেটার কৃতিত্ব অনেকেই প্রশংসা করে। কেউ এখন আর তাকে মুখ ভেংচি দেয় না।
শ্রাবণ মাস।
বৃষ্টির মৌসুম, তবুও মেঘ নেই। আকাশ সম্পূর্ণ নীল। কাশফুল ফেটে চারদিকে শরতের লীলা খেলা। ভেসে গেছে বড়ুাইচর খাল দিয়ে।
আলোকিক বট বই কী, শ্রাবণে শরতের দেখা!
ঐখান থেকে কাশফুল সংগ্রহ করে তৌহিদ। মনোরম দৃশ্য সে অনুভব করে সেখান থেকে।
একদিন ভাবল, পুষ্পকে নিয়ে কাশফুল বাগানে ভ্রমণে যাবে।
খুবই সুসংবাদ। খালা অন্তঃসত্ত্বা। তৌহিদের নতুন ভাই হবে। খালু এখন বাড়িতে।
হঠাৎ একদিন তৌহিদের বাবার চিঠি এল। সেখানে লেখা ছিল—
“তৌহিদ, তোমার জন্য বন্দোবস্ত সকল কিছু হয়ে গেছে। নতুন বছরের নয়, তুমি বাংলা ভাদ্র মাস থেকেই ফরিদপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়ন করবে। খেয়াল রেখো। তোমার খালার সুস্থতা কামনা করি।”
তৌহিদ এই কথা শুনে বাংলার পাঁচেরর মতো হয়ে গেল।
এই বিস্তৃত জনপদ, যেখানে তার সমস্ত পরিচয়— সেখান থেকেই তাকে ফিরে যেতে হবে।
বিষণ্ণ মন ও ভাব— দুটোই।
তৌহিদের সেইদিন আর ঘুরতে বের হওয়া হলো না।
আলোকিক শরৎ ও কমন করে যেন হারিয়ে গেল।
বর্ষার পরিচিত ফিরে পেল।
গত দুদিন ধরে কী দুর্দান্ত বৃষ্টি না হচ্ছে!
বাসা থেকে বের হওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে সবার জন্য।
নতুন স্থানে যোগদান দিতে বাধ্য হয়ে গ্রাম্য মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নাম কেটে ফেলেছে তৌহিদ।
খালার যত্নও কমে এসেছে।
তাকে এখন কেউই খেয়াল করে না বলা চলে।
তৌহিদও ওর বাবার প্রস্তাবের দিকে ধাবিত হতে থাকছে।
এমন একদিন সে সেই বুড়াইচের খালটার পাশে বসে আছে।
সেখানে একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি ছিল।
বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে বহু বছর ধরে।
কেউ সাহস করে ঐদিকে চোখও দেয় না।
তৌহিদ তার কিছু বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। সবাই বাড়ির জন্য তাগাদা দিলেও তৌহিদের মধ্যে তা নেই।
খালা তো এখন আর তৌহিদকে খেয়াল করে না।
সেখানে তারা যা দেখল, তার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না।
আসলে ঐ জমিদার বাড়িটা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে থাকতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল মাদক বিক্রেতাদের আড্ডায়।
ওর নির্দেশে একজন দৌড়ে থানায় গিয়ে খবর দিতে যায়।
এদিকে বাকিরা ফাঁদ আঁটে কীভাবে ওদের প্রতিহত করা যায়।
যেহেতু এটা ছিল পরিত্যক্ত বাড়ি, তাই তারা বিভিন্ন অব্যবহারযোগ্য ও কৃষি অস্ত্র নিয়ে কেউটে ভূত সেজে ভয় দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
যেমন ভাবা, তেমন কর্ম।
ভূতের ভয়ে মাদক কারবারীরা একগুচ্ছ হয়ে যায় এবং পুলিশ দ্রুত এসে তাদের ধরে ফেলে।
তৌহিদ ওর বন্ধুদের সাথে সেদিন একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছিল।
পরদিন খবরের কাগজে এটা ছাপা হয়।
সব স্বাভাবিক চলতে থাকলেও তৌহিদ এখন পুরোপুরি ভারাক্রান্ত।
কালই তাকে ছেড়ে যেতে হবে এই গ্রাম।
তাই আজ বন্ধু ও প্রতিবেশীদের সাথে তেমন কথা বলল না।
সবাইকে না জানিয়েই যেন স্বার্থপরতাটাকেই উঁচিয়ে ধরল তৌহিদ।
খালা সকল কিছু ওকে গুছিয়ে দিয়েছে।
শ্রাবণ মাসের আজ শেষ দিন।
যাওয়ার পথে দুই নয়নে তৌহিদ ধোঁয়াশা দেখে বড়ায়।
এই অমৃত স্মৃতি ভুলবে না সে— এই দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সে উদ্ধত হচ্ছে।
মৃদু সুরের বাধানো চাচ্ছে,
“বিদায় শ্রাবণ।”