ঝুম বৃষ্টির রাতে গ্রামের আকাশে এক ধরনের কান্না বাজে—মেঘের গর্জনে, পাতার কাঁপনে, যেন আকাশের চোখও কাঁদছে আজ। গ্রামের নাম ধানবিল—নাম যেমন শান্তিপূর্ণ, রাত নামলে ঠিক ততটাই অদ্ভুত। গ্রামের মাঝখানে একটা পুরনো পোড়োবাড়ি, ঝোপঝাড়ে ভরা, কেউ সেখানে যায় না। কারণ, সবাই জানে—ওখানে “সে” আছে।
সে মানে?
একটা মেয়ের আত্মা, সাদা শাড়ি পরা, ভেজা চুলে দাঁড়িয়ে থাকে ঘরের জানালায়। রাত যত গভীর হয়, কালো মেঘে গর্জন বাড়ে, আর তার কান্নাও।
শুধু একটাই মানুষ, যে ভয় পায় না—নাম তার তরিতা। ধানবিল কো অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয় এএ বিজ্ঞান শিক্ষিকা। গ্রামে ফিরেছে শহর থেকে মাস খানেক হলো।
তরিতা শুনেছে গল্পটা—
তিন বছর আগে এক তরুণীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এই বাড়িতে। তার অপরাধ? সে বলেছিল—“এ গাঁয়ের পানি বিষাক্ত, সবাই অসুস্থ হবে।” কেউ বিশ্বাস করেনি। সে মেয়েটি মারা যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই গ্রামের লোক এক অজানা রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। শরীর জ্বালাপোড়া, চোখ লাল, গা ঘামা।
তরিতা শহর থেকে মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। সে জানে, এটা পানিবাহিত রোগ—যা এক ধরনের কেমিক্যালের কারণে ছড়াচ্ছে, ঠিক যেমন সেই মেয়েটা বলেছিল।
তরিতা একদিন গভীর রাতে সেই পোড়োবাড়িতে গেল। ঝুম বৃষ্টি, গর্জন, কুয়াশা আর ভয় যেন বাতাসে ঘন হয়ে উঠেছে। সে বাড়ির ভেতরে ঢুকল, হাতে শুধু একটি ল্যাব টেস্ট কিট, আর সাথে একটা লন্ঠন।
জানালার ধারে হঠাৎ দেখা গেল ভেজা চুলে এক সাদা শাড়ি পরা মেয়ে।
তরিতা কাঁপলেও ভয় পেল না। বলল,
“আমি জানি তুমি মিথ্যা বলোনি। আমি তোমার কথা প্রমাণ করতে এসেছি।”
মেয়েটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন এক আশীর্বাদ জানিয়ে চলে গেল কোথাও।
পরদিন তরিতা পানি নমুনা সংগ্রহ করে উপজেলা স্বাস্থ্য দপ্তরে পাঠাল। রিপোর্ট এল—পানিতে একধরনের বিষাক্ত লিকুইড পাওয়া গেছে, যা একটা পুরনো কারখানা থেকে গোপনে ফেলা হত পাশের খালে।
গ্রামবাসী প্রথমে ভয় পেয়ে তরিতাকে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এরপর যখন সরকারি টিম এল, পানির উৎস বন্ধ হল, নতুন টিউবওয়েল বসানো হল, গ্রামের রোগ ধীরে ধীরে কমতে লাগল—তখন সবাই বুঝল তরিতা কোনো সাধারণ মেয়ে নয়।
সে-ই হলো ঝুম বৃষ্টির রহস্যময়ী কন্যা।
যে ভূতের ভয় ভুলে সত্যকে জিতিয়েছে,
কালো মেঘের গর্জনের মাঝে দাঁড়িয়ে
একটি গ্রামের প্রাণ বাঁচিয়েছে।