মো: রিয়াদ হোসেন
মুমতাহিনা করিম মীম। যুক্তরাষ্ট্রের হেনড্রিক্স কলেজ থেকে পেয়েছেন ‘হ্যাস মেমোরিয়াল স্কলারশিপ’। এই ফুল-রাইড স্কলারশিপ প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শুধুমাত্র চারজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে প্রদান করা হয়। সেই গৌরবময় তালিকায় স্থান করে নেওয়া মীম তার প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেছেন সাহসের সঙ্গে। লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
যুক্তরাষ্ট্রের হেনড্রিক্স কলেজ থেকে প্রেস্টিজিয়াস ‘হ্যাস মেমোরিয়াল স্কলারশিপ’ অর্জন করেছেন মুমতাহিনা করিম মীম। এটি একটি ফুল-রাইড স্কলারশিপ, যা প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চারজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে প্রদান করা হয়। সেই গৌরবময় তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন মুমতাহিনা করীম মীম। এই অসাধারণ অর্জনের পাশাপাশি মীম যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পেয়েছেন। সব মিলিয়ে তার প্রাপ্ত স্কলারশিপের পরিমাণ প্রায় ৩৬ কোটি টাকা।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
মীমের জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ঐতিহ্যবাহী সরফভাটায়। চট্টগ্রামেই কেটেছে শৈশব ও কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ছিল আগ্রহ। মীমের ছবি আঁকার বিষয়বস্তু কখনো বইয়ের নিয়মে বাঁধা ছিল না। নিজের মনের আনন্দেই যা ভালো লাগতো, তাই আঁকতেন। একসময় মায়ের কাছ থেকেই কোডিং শিখেন মীম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন নিজের স্কুলের ওয়েবসাইট তৈরি করেন। তার এই কাজ দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যান। শিক্ষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘এই মেয়ে একদিন বড় কিছু করবে!’
কটু কথার দেয়াল
এরপর একে একে নতুন উদ্যোগে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকেন। নবম শ্রেণিতে উঠে প্রতিষ্ঠা করেন প্রোগ্রামিং ক্লাব, যেখানে সদস্য ছিল ৬৫ জন। নিজ হাতে শিক্ষার্থীদের কোডিং শেখাতে শুরু করেন। তার নেতৃত্বে ক্লাবের দল জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে। তবে এতসব অর্জনের মাঝেও অনেকে নেতিবাচক কথা বলতেই থাকেন। কেউ কেউ বলতেন, ‘এসব করে কী হবে? পড়াশোনা তো গোল্লায় যাবে!’ কিন্তু মীম প্রমাণ করেছেন, আন্তরিকতা আর লক্ষ্য ঠিক থাকলে সৃজনশীলতা আর পড়ালেখা–দু’টিই একসাথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
ঘরই যখন রোবটিক্স ল্যাব
করোনাকালীন লকডাউনে ইউটিউব দেখে শেখেন নানান প্রজেক্ট। নিজের জমানো সঞ্চয় আর যাতায়াতের খরচ থেকে বাঁচানো টাকায় কিনেন একটি আরডুইনো কিট ও বিভিন্ন ধরনের সেন্সর। তার ছোট্ট ঘরই পরিণত হয় মিনি রোবটিক্স ল্যাবে। আর সেখানেই মীম তৈরি করেন প্রথম ফুড-সার্ভিং রোবট– ‘কিবো’।
স্বপ্নের পথে…
মীমের আজকের সাফল্যের পথটা সহজ ছিল না। মীম বললেন, ‘মেয়ে হিসেবে বিজ্ঞান, কোডিং বা রোবটিক্স নিয়ে স্বপ্ন দেখা কখনোই সহজ ছিল না। অনেকেই বলত, মেয়ে হয়ে এত বড় স্বপ্ন দেখতে নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়; সে ছেলে হোক বা মেয়ে। ইচএসসি শেষ করে যখন সবাই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন আমি একা হাতে শুরু করি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন প্রক্রিয়া।’
অনুপ্রেরণায় যাঁরা
চট্টগ্রামের অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং কাপাসগোলা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন মীম। সেই শুরু থেকে নিজের লক্ষ্য ঠিক রেখে এগিয়ে গেছেন সাহস, একাগ্রতা আর নিজের ওপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে। ভালো স্কলারশিপ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা মীমের পরিবারের পক্ষে ছিল প্রায় অসম্ভব। লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট—আর সেই লক্ষ্য পূরণে মীম লড়েছেন নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে। রাতের পর রাত জেগে তৈরি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লিকেশন, দিয়েছেন ইংরেজি দক্ষতা যাচাইয়ের পরীক্ষা এবং একাধিকবার স্যাট পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একের পর এক স্কলারশিপ অফার পেতে শুরু করেন। এই অর্জনের জন্য মীম পরিবার এবং প্রিয় শিক্ষক মিজানুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান অফার লেটার
যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ও লিবারেল আর্টস কলেজ থেকে পড়াশোনার জন্য অফার লেটার পান মীম। এর মধ্যে রয়েছে হেনড্রিক্স কলেজ, ফ্র্যাংকলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজ, কলোরাডো ইউনিভার্সিটি বোল্ডার, পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি, নক্স কলেজ, স্পেলম্যান কলেজ, ক্লেমসন ইউনিভার্সিটি সহ আরও অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান। মীমের জন্য সবচেয়ে বিশেষ এবং গর্বের মুহূর্ত ছিল হেনড্রিক্স কলেজ থেকে ‘হেইস মেমোরিয়াল স্কলারশিপ’ অর্জন করা—একটি প্রেস্টিজিয়াস ফুল-রাইড স্কলারশিপ, যা প্রতি বছর বিশ্বের হাজারো প্রতিযোগীর মধ্য থেকে চারজনকে দেওয়া হয়।
পরিশ্রম ও প্রতিভার অনন্য স্বীকৃতি
এই বৃত্তির জন্য প্রথমে ইমেইলের মাধ্যমে মীমকে জানানো হয় যে, তিনি ফাইনাল রাউন্ডের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং তার ইন্টারভিউ হবে শিগগিরই। উত্তেজনা ও প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ইন্টারভিউয় দেন মীম। কয়েকদিন পর, হেনড্রিক্স কলেজের কর্তৃপক্ষ তার সাথে একটি বিশেষ মিটিং করে। সেখানে তাকে জানানো হয়, তিনি নির্বাচিত হয়েছেন হেইস মেমোরিয়াল স্কলারশিপের জন্য। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের চারটি স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কোটি টাকার স্কলারশিপ পেয়েছেন মীম। ফ্র্যাঙ্কলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজ থেকে পেয়েছেন প্রায় ৩.৬ কোটি টাকা, ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো বোল্ডার থেকে ১.২ কোটি, রোডস কলেজ থেকে ২.৫ কোটি এবং নক্স কলেজ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকার স্কলারশিপের অফার। এটি তার মেধা, পরিশ্রম ও প্রতিভার অনন্য স্বীকৃতি। মীম বিশ্বাস করেন, জীবনের পথচলায় ব্যর্থতা আসবেই তাই বলে থামা চলবে না। তার কাছে প্রতিটি ব্যর্থতা একেকটি শেখার ধাপ, সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি। মীম মনে করেন, সত্যিকারের চেষ্টা আর নিজের ওপর বিশ্বাস থাকলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই পৌঁছানো যায় সাফল্যের চূড়ায়!