প্রতিবেদক: রাহুল বড়ুয়া
বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলোর মধ্যে রথযাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও হৃদয়স্পর্শী উৎসব। এটি মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক বৃহৎ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, যা প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয়। এই দিনে মন্দির চত্বর থেকে শুরু করে রথযাত্রার রাস্তাগুলো ভক্তদের ভিড়ে পূর্ণ হয়ে ওঠে, আর চারদিকে বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি, কীর্তন ও ধর্মীয় সঙ্গীত।
রথযাত্রার ইতিহাস ও তাৎপর্য:-
রথযাত্রার উৎপত্তি ভারতের ওড়িশার পুরী শহরে, যা আজও রথযাত্রার মূল কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত। পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, তাঁর ভাই বলরাম এবং বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে মাসির বাড়ি গুণ্ডিচা মন্দিরে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই রথযাত্রার সূচনা, যা আজ লাখো ভক্তের অংশগ্রহণে পরিণত হয়েছে এক বিশাল ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আয়োজনে। রথযাত্রা শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়—এটি এক ভক্তি, আত্মসমর্পণ ও মানবিকতার অনন্য মিলনমেলা। জাত, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সকলেই একত্রে দড়ি টেনে রথ টেনে নিয়ে যান, যা সামাজিক সাম্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
রথযাত্রা পালনের প্রক্রিয়া:-
রথযাত্রার জন্য প্রস্তুত হয় তিনটি বিশাল কাঠের রথ—ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার জন্য। এসব রথ সুসজ্জিত করে, ঘন্টা ও ঢাকের শব্দে, ভক্তরা দড়ি ধরে টানতে শুরু করেন। এগুলো গন্তব্যস্থল গুণ্ডিচা মন্দিরে গিয়ে পৌঁছায় এবং সেখানে নয় দিন অবস্থানের পর আবার ‘উল্টো রথে’ ফিরে আসে মূল মন্দিরে। এই সময়টিতে চলে ধর্মীয় গান, কীর্তন, প্রসাদ বিতরণ, মেলা ও নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই উৎসব ধর্মীয় চেতনা ও আনন্দের অনন্য মিলন ঘটায়।
বাংলাদেশে রথযাত্রার বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন:-
বাংলাদেশেও রথযাত্রা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির, জয়কালী মন্দির, সুত্রাপুর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়াও চট্টগ্রামের পটিয়া, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, কাপ্তাই, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় রথযাত্রা ঘিরে চলে বর্ণিল আয়োজন। রথযাত্রা উপলক্ষে বসে মেলা, আলোকসজ্জা হয় মন্দির ও আশপাশের এলাকা জুড়ে, আয়োজন হয় ধর্মীয় র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হাজারো ভক্ত ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে উৎসব হয়ে ওঠে আনন্দমুখর।
উপসংহার
রথযাত্রা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়—এটি এক মিলনের উৎসব, সংস্কৃতির ধারক এবং মানবিকতার এক অনন্য বার্তাবাহক। এই মহোৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভক্তি, সহানুভূতি ও সম্প্রীতির গুরুত্ব। প্রতিটি রথের চাকা যেন বয়ে আনে নতুন শুভবোধ, শান্তি ও সমাজে সাম্যের বার্তা।
তথ্যসূত্র:-শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ